রাজকুমার মুখার্জীঃ দীঘা। একটা ছোট্ট শব্দ -- লুকিয়ে আছে ভালো লাগার পরশ; এই তো ঘুরে এলাম। জানি জানি, এখনই হৈ হৈ করে বলবেন "ওহ দীঘা! ক...
রাজকুমার মুখার্জীঃ দীঘা। একটা ছোট্ট শব্দ -- লুকিয়ে আছে ভালো লাগার পরশ; এই তো ঘুরে এলাম। জানি জানি, এখনই হৈ হৈ করে বলবেন "ওহ দীঘা! কতবার গেছি। ধুস কি ভীড়।" আমি দীঘা দেখলাম একটু অন্য চোখে -- দীঘা মানেই ঠাণ্ডা বিয়ার খেয়ে সমুদ্র স্নান নয়। আপনি সে দলে নন, তাও জানি। আসুন দেখি দীঘার না বলা যন্ত্রণা -- নাহয় একবার সেই ক্ষতে একটু মমতার হাত বুলিয়ে দিই।
সপ্তাহের শেষ দুদিন অথবা একদুই দিনের ছুটি মানেই বাঙালির " দীপুদা"। দীঘা - পুরী - দার্জিলিং। দীঘার সৌন্দর্যকে নষ্ট করার মুলে আমরা। অমন সমুদ্র ছেড়ে আর্টিফিসিয়াল লেক, টয় ট্রেন - এতো মচ্ছব। আমি প্রথম দীঘা যাই বাবা, মা, দাদার সঙ্গে প্রায় ৫০ বছর আগে। তখন খড়গপুর অবধি লোকাল ট্রেনে গিয়ে সেখান থেকে বাসে। থাকার জায়গা ছিল দুটি। সৈকতাবাস আর সরকারী অতিথিশালা। দরমা দেওয়াল দেওয়া ভাতের হোটেল - জনপ্রিয় হোটেল। ছিল বিশাল ঝাউবন, উঁচু থেকে নিচে গড়িয়ে নেমে আসা বালিয়াড়ি, নীল সমুদ্রের ঢেউ। সরকারি অতিথিশালার ঘরে বসে শোনা যেত সমুদ্রের গর্জন।
তারপর বহুবার দীঘা এসেছি। এবার এলাম দশ বছর পর। প্রতিবার দেখি শহুরে সভ্যতার করাল ছাপ এর সৌন্দর্যকে গিলে খেতে চলেছে। কে বা কারা অথবা কি করে যেন ঝাউবন কেটে সাফ হয়ে গড়ে উঠছে ইঁট কাঠের জঙ্গল। নিত্য নতুন সুবিধাযুক্ত হোটেল, খাবারের দোকান, মদের ফোয়ারা। বীচ বাঁধানো হলেও, বোল্ডার এর ফাঁক দিয়ে উঁকি মারছে কাগজের কাপ, প্লাস্টিকের বোতল, মদের খালি বোতল। পাল্লা দিয়ে শোভা বাড়াচ্ছে পান গুটকার পিকের আলপনা। সার দিয়ে দোকানঘর। সমুদ্রের দিকে চেয়ে দু দুন্ড চুপ করে বসার জো নেই। হার, মালা, কানেরদুল, শঙ্খ - হকারের পর হকার।
এতক্ষণ তো বললাম শুধুই দোষের কথা। এবার বলি কি জন্য আপনি দীঘা আসবেন -- একবার নয়, বারবার। সবার আগে বলি, সপ্তাহের শেষে নয়। পারলে ঘোষিত ছুটি এড়িয়ে নিজেই কাজ থেকে ছুটি নিয়ে চলে আসুন। খুব ভোরে যখন সূর্যদেব আকাশের বুকে এক মুঠো লাল আবির ছড়িয়ে নিজের উপস্থিতি জানান দিতে যাবেন -- ঠিক তার আগে চলে আসুন বীচ। বাঁধানো ধাপে বসে দিগন্তের দিকে চুপটি করে চেয়ে বসে থাকুন। চরাচর পরিষ্কার থাকলে কমলালেবু রঙের সূর্য জলের ভিতর থেকে উঠছে দেখলেও দেখতে পেতে পারেন। দিনের প্রথম আলোর স্পর্শ গায়ে মেখে নতুন দিনকে নাহয় আপনি অভ্যর্থনা জানালেন - মন্দ কি? হটাৎ শুনবেন স্তম্ভের গায়ে লাগানো মাইকে রবীন্দ্রনাথের গান "হে নুতন দেখা দিক বারবার.....।" পাথরের উপর আছড়ে পড়া সমুদ্রের ঢেউ দেখতে দেখতে সময় যাবে পেরিয়ে।
![]() |
চন্দনেশ্বর মন্দির, উড়িষ্যা |
![]() |
তালসারি, উড়িষ্যা |
" তোমার কথা হেথা কেহ তো বলে না
করে শুধু মিছে কোলাহল......।"
জানি আপনি কোলাহল করার দলে নন -- তবুও আনন্দে উত্তেজিত হয়ে কোলাহল করলে থাকবে না ।
![]() |
উদয়পুর বীচ |
এবার চলুন ফেরা যাক হোটেলে। সমুদ্র স্নান করতে হবে। তারপর খেয়ে একটু বিশ্রাম করে বিকালে বেরোতে হবে। একটা নতুন জায়গায় নিয়ে যাবো।
ওহ! একটা কথা তো বলাই হল না। হাওয়া যখন উত্তর দিক থেকে আসে, শীতে, তখন অমাবস্যা পূর্ণিমা ইত্যাদি তিথি ছাড়া ঢেউয়ের তালে তালে নেচে সমুদ্রে স্নান করা যায় না। ঢেউ থাকে সামান্য। দখিনা হাওয়ার সময়, গরমে, সমুদ্রে ঢেউ থাকে বেশী, স্নানের মজাই আলাদা।
![]() |
মোহনা মারিন ড্রাইভ |
বিকেল বিকেল বেড়িয়ে পড়ি। ওই তো একটা অটো যাচ্ছে, চলুন ওটা ধরে চলে যাই মোহনা। মারিন ড্রাইভ রাস্তাটি চমৎকার। মাছের বাজারের আঁশটে গন্ধ ছড়িয়ে কংক্রিটের রাস্তা ধরে মোহনার মুখে যাওয়া যাক। চম্পা নদী এখানে সাগরে এসে মিশেছে। পড়ন্ত বিকেলে জোয়ার আসে। গভীর সমুদ্রে যারা মাছ ধরতে যান, ট্রলার নিয়ে একে একে ফিরে আসছেন। শুনেছি একটা বড় ট্রলার নিয়ে সমুদ্রে মাছ ধরতে যাবার খরচ এক লাখ টাকারও বেশী। ওনারা পুঁজির ফসল নিয়ে ফিরছেন। কংক্রিটের রাস্তার উপর ঢেউ ভাঙা দেখুন। জল পায়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। আকাশের দিকে তাকাতে ভুলবেন না। শ্রান্ত দিবাকর দিনের শেষ আলোটুকু সমুদ্রের উপর ছড়িয়ে দিয়ে ঘরে ফিরে যাচ্ছেন। নির্জন সমুদ্র সৈকতে আপনি তার সাক্ষী হয়ে থাকলেন। এই মনমাতানো দৃশ্য আপনার জন্য - শুধু আপনার জন্য, আপনি যে প্রকৃতি উপভোগ করতে এসেছেন।
সন্ধ্যায় হকারের হাঁক ডাক উপেক্ষা করে সমুদ্রের ধারে বসে জল এগিয়ে আসা দেখতে থাকুন। ঢেউ একের পর এক ভাঙছে। সব ঢেউ ভাঙছে না, একটা কিন্তু ফিরে যাচ্ছে -- খুঁজে দেখুন কোনটা !! বেশ মজার খেলা। দিন নেই রাত নেই - একই কাজ করে চলেছে। ঢেউ ভাঙা গড়ার খেলা দেখতে দেখতে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নামবে। চলুন যাই হোটেলে। কাল যে ফিরে যেতে হবে সেই গতানুগতিক জীবনে, আমাদের টিকি যে বাঁধা।
কথা দিলাম সুন্দরী দীঘা, আবার আসবো তোমার কাছে।
COMMENTS