সত্য কাহিনী অবলম্বনে মনীষ সাহার গল্প “গল্পের শেষ কোথায়”

  মনীষ সাহা, কল্যানীঃ  জন্মেছিলাম শহরের নামকরা করা এক হোমিওপ্যাথি ডাক্তার এর বাসগৃহে। তখন হাসপাতাল,সীজার এগুলো এত জনপ্রিয়তা পায়নি। সবাই বলে ...

 


মনীষ সাহা, কল্যানীঃ জন্মেছিলাম শহরের নামকরা করা এক হোমিওপ্যাথি ডাক্তার এর বাসগৃহে। তখন হাসপাতাল,সীজার এগুলো এত জনপ্রিয়তা পায়নি। সবাই বলে আমার এক দিদার হাতে আমি জন্মেছিলাম। উনিই ছিলেন ধাত্রী।

জন্মের পর পরই চরম ভালবাসার বেস্টনীতে বড় হতে থাকি আত্মীয়স্বজন সবার ভালবাসাকে পাথেয় করে। অন্নপ্রাশনে পুরো গ্রাম নেমন্তন্ন করে আমার ভগবানতুল্য বাবা।

সুখপাখি যখন আমায় নিয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে, খুবই ভাল ছাত্রের স্বীকৃতি নিয়ে যখন আমি ক্লাস থ্রি বা ফোর ঠিক তখনই আমার মায়ের কোলে আমাদের ঘর আলোকিত করে আমার ছোট বোন। তারই বছর তিনেক পড়ে আমার দ্বিতীয় ছোট বোন।


ততদিনে আমি ক্লাস সিক্স অথবা সেভেন। খুবই ভাল ছাত্র হওয়া স্বত্ত্বেও দুস্টুমিতে সেরা হয়ে যাই বাবার চোখে। অগত্যা ঢিল ছোড়া দুরত্বে আমার স্কুল হওয়ার পরও আরও ভালো পড়াশুনার নিমিত্তে আমার ঠাঁই হয় স্কুল হস্টেলে।বঞ্চিত হলাম মায়ের স্নেহ ভালবাসা আর বাবার আদর থেকে।

অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত মাধ্যমিকের গন্ডি পেড়িয়ে ভর্তি হলাম কলেজে। কলেজেও যেতে পারিনি মায়ের হাতের রান্না খেয়ে।কোন এক অজানা কারণে ভর্তি করা হোলো বাড়ি থেকে প্রায় পঞ্চাশ কিমি দুরে একটি কলেজে। তার থেকে ভালো কলেজ ছিল আমার বাড়ি থেকে এক নিঃশ্বাসে পৌছানোর মত জায়গায় ।আমার থাকার ব্যাবস্থা হোলো আমার ছোট বেলার এক প্রাইভেট টিউটরের বাড়িতে।

এগুলো যখন আমার জীবনে চরম অস্বস্তির রুপ নিল ঠিক তখনই সব কিছু ছেড়ে সবার অবাধ্য হয়ে ফিরে এলাম আমার নিজের শহরে নিজের কলেজে। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরী হয়ে গেছে। জীবনের পড়াশুনা এবং ভালোমানুষ হওয়ার আকাঙ্খা ততক্ষণে জলাঞ্জলি দিয়ে ছোটা শুরু করলাম রাজনীতি আর টাকার পেছনে।

আর তখন থেকেই নাম লেখালাম বখাটেদের খাতায়। আর উশৃঙ্খল সন্তান তো কোন মা-বাবার সন্তুষ্টির কারণ হথে পারে না।লেখাপড়া শেষ করলাম অনাকাঙ্খিত ডিগ্রি নিয়ে। শুরু হোলো অনাকাঙ্ক্ষিত অধ্যায়।নেশার জগত থেকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে আমায়।

খুব বেশিদিন এভাবে কাটাতে হয়নি আমায়।বাবা খুব শিঘ্রই আমায় দেশান্তরের ব্যাবস্থা করলো। এবার আমি আমার রাজ্যে অলিখিত রাজা।বাবার টাকায় শুরু হল জীবনের আর একটি অধ্যায়। বাবার অকৃপণ ভালবাসায় আপ্লুত হয়ে নিজেকে নিয়ে ভাবার অবকাশ পেলাম না।বাবা বোলতো আমি নাকি ছোট,কোন কাজই নাকি করতে পারবনা।বাবার এই পাহাড়সম ভালবাসায় আমি তৈরি হয়ে গেলাম এক অকম্মার ঢেঁকি

কখনও বসন্ত কখনও শ্রাবন এভাবেই অগ্রসর হতে লাগল আমার জীবন।চলতে চলতে একটা সময় নিজেকে বড় একা মনে হতে লাগল।একটা ব্যাবসার সঙ্গে যুক্ত এবং পেছনে বাবার ব্যাকিং মিলিয়ে মিশিয়ে ভালোই চলছিল।তবে সারাদিন হোটেলের খাবারের উপর ভরশা করেই চলতে হোতো। আমি খাবার খেতাম দুবার। তাও প্রায়ই রাতের খাওয়াটা হোতো না। প্রচুর ঐশ্বর্য আমাকে রঙিন জগতে টেনে নিতে খুব একটা সময় নেয়নি।

এভাবে চলতে চলতে একদিন অসুস্থতা ঘিরে ধরলা আমাকে।এবং একজনের উপস্থিতি আমার জীবনে অসম্ভব রকমের প্রয়োজন হয়ে পরলো। আমিও দেরী না করে সোমাকে জীবনসঙ্গিনী হিসেবে বেছে নিলাম। এরপর থেকেই জীবনটা অন্যরকম হয়ে গেল। 

কিন্তু সুখ আমার সইলো না, অসুস্থতা ধীরে ধীরে আমার জীবনটাকে দুর্বিষহ করে তুললো। আর এরই মধ্যে বাবা মাও  যোগাযোগ কমিয়ে দুরত্ব বাড়িয়ে দিল।

এভাবে চলতে চলতে একটা সময় বাবার দুরত্ব আমাকে অচলপ্রায় করে দিল। তাছাড়া জীবনের ভালো সময়গুলোতে অপচয়ের কারণে ঈশ্বরও আমার মাথা থেকে হাত তুলে নিল।

আর অপেক্ষা না করে ছুটে গেলাম বাবার কাছে। দিনটি ছিল ২০১৯ সালের ৬ ই ডিসেম্বর। গিয়ে দেখলাম বাবা প্রায় শয্যাশায়ী। আমি বাবার উন্নত চিকিৎসা করাতে চাইলে বাঁধ সাধলো আমার মা।আমাকে জানানো হোলো বাবা যেহেতু হোমিওপ্যাথ চিকিৎসক উনি নাকি হোমিওপ্যাথিক  চিকিৎসার উপরেই নির্ভরশীল। এলোপ্যাথিক ডাঃ মা দেখাতে চাইলেন না।অথচ আমি দেখলাম বাবার কাশির সাথে রক্ত পরছে। যাই হোক, আমার বাবার কাছে পৌছানোটা মা ভালভাবে কেন নিতে পারলেন না আমার জানা নেই।

আমি রওনা দেবার আগেও আমার মা এবং তার সেজো ভাই দুজন মিলে বিভিন্ন রকম ভয় ভীতি দেখায়।শেষ পর্যন্ত আমার বাবার কাছে পৌছানোর পরের দিন অর্থাৎ ৭ ই ডিসেম্বর আমি বিকেলে এক বন্ধুর ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যাই একটি এক্সরে করানোর জন্য আমার বাবারই পরামর্শে। ওখানেই হঠাৎ একজনের মুখে শুনতে পাই আমার বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে,বাবা স্ট্রোক করেছেন।হাসপাতালের সামনেই ছিলাম আমি।পৌঁছাতে সময় লাগলো না।

ছুটে গিয়ে এক নতুন দৃশ্যের সন্মুখীন হলাম।বাবাকে যে রুমে ভর্তি করা হোলো সেই রুমের গেটে মায়ের দুই মামাতো ভাই আমার সাথে খুবই বাজে ব্যাবহার করা শুরু করলো।আমাকে বলা হোলো আমার বাবার এই অসুস্থতার জন্য নাকি আমিই দায়ী। আমাকে ঢুকতে দেয়া হোলো না। বাবার সামনে যেতে দেওয়া হোলোনা। আমার জীবনে নেমে এল অন্ধকার অভিশপ্ত মুহুর্ত। কিছুসময়ের মধ্যেই  আমায় ফাকি দিয়ে আমার বাবা চলে গেলেন অনন্তের উদ্দেশ্যে।শেষমুহুর্তে একনজর দেখতেও পারলেন না তার একমাত্র ছেলেকে।


আমাদের হিন্দু শাস্ত্রমতে বাবার মুখাগ্নি ছেলেকেই করতে হয়।কিন্তু আমি শ্মশানে গিয়ে জানলাম আমার বাবার মুখাগ্নি আমি করতে পারব না কোন এক অজানা কারনে।বাঁধা প্রদান করল আমার মা এবং তার সেজো ভাই সহ মামাতো দুই ভাই।অনেক বাকবিতন্ডার পরে অবশেষে আমাকে মুখাগ্নি করতে দেয়া হোলো এক শর্তে। আমার মা মুখাগ্নি করবেন এবং আমি তাকে স্পর্শ করে থাকব।

ভাগ্যের নির্মম পরিহাস যে আমাকে মেনে নিতে হোলো এই পুরোটাই। আমার প্রশ্ন হিন্দুধর্মের শাস্ত্রীয় গুরুজনদের কাছে যে এটা কোন নিয়মের মধ্যে পরে। আমার শহর আমার মাটির কাছে আমাকে খারাপ প্রমান করার আপ্রান চেষ্টায় তারা সফল হোলো। কারণ আমি আমার শহরে প্রায় ২৫ বছর বাদে। আর আমার মা ঈশ্বরের পূজারী। তার ভাইয়েরা সমাজে প্রতিস্ঠিত। আমার চাওয়া বা আমার কথা তাদের বা আমার শহরবাসীর কাছে আজ হাস্যকর।


গল্পের শেষ পর্যায়ে অনেককিছুই আর বাড়াতে ইচ্ছে হোলোনা।শুধু কয়েকটা কথা না বললেই নয়। আজ আমি মৃতপ্রায়।দুবার হার্ট অ্যাটাকের পরে যখন আমি হাসপাতালে প্রথম দিন ভর্তি হই, সেদিন ডাঃ আমাকে ২৪ ঘন্টা সময় দেয় এবং সে খবর জানতে পেরে আমার মৃত্যু কনফার্ম জেনে আমার মা বোনেরা আমায় দেখতে যায় হাসপাতালে। 

কিন্তু তারপরে আমাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য অন্য হাসপাতালে রেফার করা হয় সেখানে আমার বুকে স্টেইন বসানো হয়। খুবই মারত্মক পরিস্থিতিতে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে আজ আমি ঈশ্বরের ইচ্ছেতে হার্টের সমস্যা থেকে মুক্ত হোলেও রোগমুক্ত নই।

তৈরি হচ্ছি আবার অপারেশনের জন্য।পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে যে.....

|| সমাপ্ত ||

এই গল্পটা আমি উৎসর্গ করলাম আমার জন্মস্থান আমার মাটির শহরের সমস্ত শহরবাসীকে। আমার এই লেখার মধ্যে যদি কোন প্রশ্ন খুঁজে পান। আমার কান্নার কোন শব্দ আপনাদের কানে বাজে, আমাকে জানিয়ে বাধিত করবেন।আজ সবাই থাকতেও আমার কেউ নেই।আমার জন্মস্থানের সবাই আজো আমাকেই দোষী করে।এই দোষ মাথায় নিয়ে তো আমি মরেও শান্তি পাবনা। এই পঞ্চাশের কোঠায় দাড়িয়ে সকলের কাছে আমার একটাই প্রশ্ন, কে আমি ????

COMMENTS

BLOGGER: 4
  1. তোমার লেখাটা পড়লাম মনীশ। তোমার মনে অনেক অভিমান ও বেদনা। আবার বাবা মায়ের মনেও তীব্র কষ্ট। একসময় তাঁদের কে তুমি খুব বেশি আঘাত দিয়েছিলে বলে উনারা মুখফিরিয়ে নিয়েছিলেন। তবে কেউ যদি নিজ কাজের জন্য ব্যথিত হয়ে তাঁদের কাছে ফিরে যায়, প্রায়শ্চিত্ত করতে চায়, তাকে অবশ্যই সুযোগ দেয়া উচিত। হয়তো কষ্টের মাত্রা বেশি ছিলো বলে উনারা পারেননি।

    উত্তরমুছুন
  2. নমস্কার নেবেন দাদা/দিদি।শুভ মহাসপ্তমীর শুভেচ্ছা জানবেন।কতটুকু লিখে মানুষকে বোঝানো সম্ভব।তবে আমার সম্বন্ধে যা কিছু সবাই জানে তার সবটুকু সত্য নয়।আবার আমিও ধোঁয়া তুলশিপাতা নই।তাহলে এত ভুগতাম না আমি।আজ একবছর আমি বিছানায়। পাপের প্রায়শ্চিত্ত করছি।তবে আমার জীবনের এই ঘটনাগুলোর মধ্যে সম্পূর্ন অন্যরকম একটা ঘটনা অপেক্ষমান।যদি আপনার পরিচয়টা দিতেন চেস্টা করতাম আমার স্বপক্ষে যুক্তির।হয়তো আপনিই ঠিক।কিন্থু এটাও ভুল নয় যে আজ আমি মৃত্যুপথযাত্রী।অন্তহীন শুভকামনা রইলো।

    উত্তরমুছুন
  3. তুই একদমই মৃত্যু পদযাত্রী না। নিজের উপর ভরসা রাখ। ঐ বয়সে মানুষ এরকম ভূল হরহামেশাই করে। তার জন্যে বাবা মা'র এতটা অবজ্ঞার স্বীকার সবাইকে হতে হয় না। তোর ক্ষেত্রে আমার মনে হয় অন্য কোন কারণ ছিল। যাই হোক তোর সুস্থতা ও ভবিষ্যতের সাফল্য কামনা করছি।

    উত্তরমুছুন
  4. হয়তো সবাই ঠিক।আমিই ভুল।তবে আমার বিশ্বাস মৃত্যুর আগে এই রহস্য আমি উদঘাটন করতে পারবো।এবং আমি জানতে পারবো,কে আমি???

    উত্তরমুছুন

নাম

অজানা তথ্য,5,আন্তর্জাতিক,6,ছোটগল্প,2,ডিয়ার বেঙ্গল,23,বিনোদন,19,ব্লগSHOT,24,ভাগ্যলিপি,1,ভারতকথা,3,ভ্রমন কাহিনী,6,লাইফস্টাইল,16,সাম্প্রতিক,100,স্বাস্থ্য কথা,13,হ্যাংলা পেটুক,6,
ltr
item
Bong24.in: সত্য কাহিনী অবলম্বনে মনীষ সাহার গল্প “গল্পের শেষ কোথায়”
সত্য কাহিনী অবলম্বনে মনীষ সাহার গল্প “গল্পের শেষ কোথায়”
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEibYlzx7tJgSOlcTCJWB7ibRSL5J_O0EqOeg4GNFmeNT-G-P1pi7FwHVsEeR95BLAyqajJnyxUGHbWRAFjeBo_08T-Mkrq1KheYnQDOngZF6ckYuBpwlTbOqjF3RQtqlPPKeURBx4xbOOJSRVog8y8v0dty5Kr1uOIbMXLxeJXlaodDAkusCHoM-m9u/s16000/my-wife-enjoys-sleeping-with-our-neighbour-man-shares-sad-story%20copy.jpg
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEibYlzx7tJgSOlcTCJWB7ibRSL5J_O0EqOeg4GNFmeNT-G-P1pi7FwHVsEeR95BLAyqajJnyxUGHbWRAFjeBo_08T-Mkrq1KheYnQDOngZF6ckYuBpwlTbOqjF3RQtqlPPKeURBx4xbOOJSRVog8y8v0dty5Kr1uOIbMXLxeJXlaodDAkusCHoM-m9u/s72-c/my-wife-enjoys-sleeping-with-our-neighbour-man-shares-sad-story%20copy.jpg
Bong24.in
https://www.bong24.in/2022/10/galper-sesh-kothay-manish-saha.html
https://www.bong24.in/
https://www.bong24.in/
https://www.bong24.in/2022/10/galper-sesh-kothay-manish-saha.html
true
3543138551337409656
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts VIEW ALL Readmore Reply Cancel reply Delete By Home PAGES POSTS View All RECOMMENDED FOR YOU LABEL ARCHIVE SEARCH ALL POSTS Not found any post match with your request Back Home Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share to a social network STEP 2: Click the link on your social network Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy Table of Content