সুধাংশু কুমার সরকারঃ বাসে সিট না পেলে অনেকে বাসের দরজার হ্যান্ডেল ধরে ঝুলতে ঝুলতে যায়। এই দৃশ্য দেখে দর্শক বলে বাদুড়ঝোলা হয়ে যাচ্ছে। কিন্ত...
সুধাংশু কুমার সরকারঃ বাসে সিট না পেলে অনেকে বাসের দরজার হ্যান্ডেল ধরে ঝুলতে ঝুলতে যায়। এই দৃশ্য দেখে দর্শক বলে বাদুড়ঝোলা হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বাদুড় তো উল্টো হয়ে ঝোলে। এখন তাহলে মনে প্রশ্ন জাগে বাদুড় উল্টো হয়ে ঝুলে কেন?
পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে প্রায় ১১০০ এর বেশি প্রজাতির বাদুড় আছে, এদের ৯৯% প্রজাতিই উল্টো হয়ে ঝোলে। বিশ্রাম নেয়া, ঘুমানো, বাচ্চা দেখাশুনার মত কাজ এরা উল্টো হয়ে করে থাকে। এরা উল্টো হয়ে ঝুলে থাকলে যে অতিরিক্ত সুবিধা পায় তা সিধে হয়ে বসে থাকলে পায় না। তাই বাদুড় সিধা হয়ে বসে না থেকে উল্টো হয়ে ঝুলে থাকে। তাহলে আসুন খুঁজে বের করি বাদুড়ের উল্টো হয়ে ঝুলে থাকার কারণগুলো নিম্নরূপ-
পেশি শিথিলতার সুবিধাঃ
মানুষসহ অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণী যারা গাছে ঝুলতে পারে তারা যদি গাছের ডালে ঝুলতে চায়, তাহলে হাতের পেশি সংকুচিত করে বেশ কষ্টে মুঠি পাকিয়ে ডাল ধরতে হয়। এজন্য শুধু কব্জির পেশিগুলোই নয়, কাঁধ ও বাহুর সমস্ত পেশি ব্যবহার করতে হয়। এতে পেশিগুলো বেশ ফুলে ওঠে। এই কাজে অনেক শক্তি ব্যয় হয়।
এই বিপুল পরিমাণ শক্তির নিরবিচ্ছিন্ন সাপ্লাই দেয়া সম্ভব নয় তাই মানব শরীরের শক্তি ফুরিয়ে গেলে মুঠি নিজে নিজে খুলে যায় আর ঝপাৎ করে নিচে পড়ে যাবে। অন্যদিকে পেশির ধর্ম হলো সংকুচিত ও প্রসারিত হওয়া। বেশিক্ষণ সংকুচিত অবস্থায় থাকার পর পেশি স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রসারিত হতে চায় এটি করতে না পারলে বিদ্রোহ শুরু করে, ফলস্বরূপ পেশি অসাড় হয়ে যায়। পেশি অসাড় হলে হাতের মুঠি এমনিতে খুলে যায় আর নিচে পরে যাবে। তাই মানুষের পক্ষে ঝুলন্ত অবস্থায় বেশিক্ষণ থাকা সম্ভব নয়। বাদুড়ের বেলায় ঠিক উল্টো ব্যাপার ঘটে।
আমাদের হাতের পেশি সংকুচিত হলে আঙ্গুল ডালের সাথে আটকে যায় কিন্তু বাদুড়ের পায়ের পেশি প্রসারিত হলে বা রিল্যাক্স অবস্থায় থাকলে তাদের পায়ের নখ ডালের সাথে দৃঢ়ভাবে আটকে যায়। মানুষের ঝুলে থাকার জন্য প্রচুর শক্তি ব্যয় হলেও বাদুড়ের ক্ষেত্রে ঝুলে থাকার জন্য বাড়তি শক্তি ব্যয় করতে হয় না। শরীরের ওপরের অংশের ওজন তার নখগুলোকে দৃঢ়ভাবে আটকে রাখতে সাহায্য করে। এই আটকে যাওয়া এতই মজবুত যে এই অবস্থায় কোন বাদুড়ের মৃত্যু হলেও তা মৃত অবস্থায় দিব্বি ঝুলে থাকে। ঘুমানোর মতো জুতসই গাছের ডাল পেলেই থাবা প্রসারিত করে, আর নখগুলো দিয়ে ডাল আঁকড়ে ধরে ঝুলে পড়ে।
সিধে হয়ে বসে আরামে ঘুমাতে চাইলে বাসা বানানোর দরকার আবার বাসা বানানোর জন্য হাজারটা জিনিষ দরকার মানে বহুত খাটুনির ব্যাপার। এসব ঝামেলায় না গিয়ে বাদুড় মাথা খাটিয়ে খুব সহজে গাছের ডালে উল্টো হয়ে ঝুলে পরে ব্যাস খেল খতম। এবার আপনি বলুন মেলা খাটাখাটি করে বোকার মত বাসা বানানো ভালো না ফট করে ঝুলে পরা ভালো?
উড়ার জটিলতাঃপাখি সরীসৃপ থেকে বিবর্তিত হয়ে উড়ার জন্য যেসকল শারীরিক বৈশিষ্ট্য দরকার সেসব অর্জন করেছে। দেহের মধ্যে বায়ুথলি, শক্তিশালী ও রূপান্তরিত উড্ডয়ন পেশি, বায়ুপূর্ণ ফাঁপা হাড়, পালক, বিশেষ পায়ের পেশি পাখিকে সহজে উড়তে সাহায্য করে। পাখি উড়ার সক্ষমতা হারিয়ে ভূমিতে চলার জন্য যেসকল বৈশিষ্ট্য দরকার সেসব বৈশিষ্ট্য অর্জন করে স্তন্যপায়ী প্রাণিতে পরিণত হয়েছে।
বাদুড় স্তন্যপায়ী প্রাণী হলেও পশ্চাৎমুখী বিবর্তনের ফলে উড়ার বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছে তাই এদের উড়ার কৌশল ত্রুটিপূর্ণ একদম পাখির মত নয়। পাখির বৈশিষ্ট্য এদের মধ্যে নেই।বাদুড়ের উড্ডয়ন করাটা পাখির মত এত সহজসাধ্য নয়।
বিমান যেমন উড়ার আগে বায়ুতে ভাসার জন্য পর্যাপ্ত গতি সৃষ্টি করতে চাকার সাহায্যে মাটির উপর দৌড় দেয়, ঠিক তেমনি কতক পাখি উড়ার আগে দৌড় দিয়ে কিছুদূর যায় তারপর ডানা মেলে উড়ে যায়। আবার কিছু পাখি পায়ের উরুতে অবস্থিত শক্তিশালী পেশির সাহায্যে স্প্রিং এর মত উপরে লাফিয়ে উঠে তারপর ডানার সাহায্যে নিম্নমুখী বায়ু প্রবাহ সৃষ্টি করে ফলে উড়ার পূর্বে দরকারি শক্তি দ্রুত সৃষ্টি হয় এবং আকাশে সহজেই উড়ে যায়।
বাদুড়ের পেছনের পা তুলনামূলক বেশ ক্ষুদ্র এবং পায়ের পেশি দুর্বলভাবে বিকশিত, একারণে এরা মাটির উপর ঠিকমত দাঁড়াতে বা সহজে দৌঁড়াতে পারেনা। একেবারে পারেনা এমন নয় তবে তা পাখির তুলনায় বেশ কঠিন।
বাদুড় মাটি থেকে উড়তে পারেনাঃ
বাদুড়কে পাখির মত উড়তে হলে উড়ার পূর্বে যে গতিশক্তি দরকার তা অর্জন করতে হবে কিন্তু এদের পক্ষে এটা তৈরিকরা সম্ভব নয়।
তবে উচু স্থান থেকে মাটিতে পরার সময় বাদুড় ডানা মেলে দিলে খুব সহজে উড়তে পারে। পাহাড় থেকে গ্লাইড করে নামার মত আরকি।
এরা যখন ডালে উল্টো হয়ে ঝুলে থাকে তখন ডাল থেকে পায়ের নখ খুলে দিলে ঝপাত করে নিচে পরতে থাকে এসময় শুধু ডানা মেলে দিলেই কাজ শেষ ফটাফট উড়তে থাকে। পাখির মত অত শক্তি খরচ করার দরকার হয় না।
তাহলে তো বুঝতেই পারছেন উল্টো হয়ে ঝুলে থাকা বাদুড়ের জন্য কতটা উপকারি
আত্মরক্ষার কৌশলঃ
বাদুড় যদি ডালে পাখির মত আরামে শুয়ে থাকে বা বসে থাকে তবে পাখির মত উড়ার আগে যে গতি শক্তি অর্জন করতে হয় তা অর্জন করতে পারবে না উড়তে বেশ সময় নষ্ট হবে।মাটি থেকে আকাশে উড্ডয়ন করা আর ডাল থেকে উড্ডয়নে প্রায় একই শক্তি ব্যয় হয়, তাই উড়ার প্রস্তুতির পূর্বেই আরেক শত্রু প্রাণী বা শিকারী আরামে এদের ধরে ফেলবে মানে সহজ শিকারে পরিণত হবে।
কিন্তু উল্টো হয়ে ঝুলে থাকলে বিপদ টের পাওয়া মাত্রই দ্রুত আত্মরক্ষার জন্যে শুধু ডাল থেকে পা ছারিয়ে নিলেই হলো নিমিষেই পগারপার। তাই উল্টো হয়ে থাকা আত্মরক্ষার এক নিখুঁত পজিশন।
এরকম উল্টো অবস্থান তাদের আত্মরক্ষা ব্যবস্থারই একটা অংশ।এর ফলে তারা যেকোনো সময় উড়াল দিয়ে শিকারীর হাত থেকে বাঁচার জন্য প্রস্তুত থাকে।
গ্রাভিটির সুবিধাঃ
আপনি যদি উল্টো হয়ে ঝুলে পরেন তখন হঠাৎ করে প্রচুর রক্ত গ্রাভিটি বা মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাবে মাথায় প্রবেশ করে ফলে মাথা ঘুরতে থাকে। তখন মাথায় চিন্তা হয়, ব্যাটা বাদুড় কিভাবে এতক্ষণ উল্টো হয়ে ঝুলে থাকে? এদের কি মাথা ঘুরে না?
একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের ওজন কমকরেও যদি ৫৫-৬০ কেজি হয় তাহলে তার দেহে রক্ত থাকবে ৫-৬ লিটার। এই বিশাল ওজন নিয়ে উল্টো হয়ে ঝুলে পরলে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি ওজনের উপর বিরাট প্রভাব ফেলে ফলে রক্ত মাধ্যাকর্ষণ শক্তির টানে দ্রুত মাথায় প্রবেশ করে এবং অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে। মাথা নিচের দিকে থাকায় সহজে রক্ত নিষ্কাশিত হয় না ফলে মাথা ঘুরতে থাকে।
কিন্তু একটি বড় আকৃতির বাদুড়ের ওজন সর্বোচ্চ ১.২ কেজি, আর তার শরীরের রক্তের ওজন মাত্র ১০০ গ্রাম। এত অল্প রক্তের ওজন মাধ্যাকর্ষণ শক্তির উপর খুব একটা প্রভাব বিস্তার করে না। তাই রক্ত চলাচল স্বাভাবিক থাকে আর বাদুড়ের মাথাও ঘুরে না। এরা সিধা হয়ে থাকলেও যা, আবার উল্টো হয়ে ঝুলে থাকলেও তা। তাই বাদুড় দীর্ঘ সময় উল্টো হয়ে ঝুলে থাকতে পারে।
৩০-১০-২০২২
COMMENTS