বাংলার ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্পের ইতিবৃত্ত - বিলুপ্তির পথে বাংলার তাঁত শিল্প ! - BONG 24

ছবিঃ বাংলার ঐতিহ্যবাহী জামদানী শাড়ী তাঁতশিল্পের ইতিবৃত্ত ! BONG 24 : প্রতিটা রাজ্য বা জাতির নিজস্ব খাদ্যরুচি, পোশাক রুচি, নিজস্ব ভাষা সংস...


ছবিঃ বাংলার ঐতিহ্যবাহী জামদানী শাড়ী

তাঁতশিল্পের ইতিবৃত্ত !
BONG 24: প্রতিটা রাজ্য বা জাতির নিজস্ব খাদ্যরুচি, পোশাক রুচি, নিজস্ব ভাষা সংস্কৃতি থাকে। আমাদের বাংলাও এই নিয়ম থেকে বহির্ভূত নয়। বরং দেশের আর পাঁচটা রাজ্যের তুলনায় বাংলা সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং শিল্পের দিক থেকে কয়েক পা এগিয়ে রয়েছে সে কথা বলাই বাহুল্য। বাংলার পোশাকের বিভিন্ন ধরনের স্বাদের ছোঁয়া পাওয়া গেলেও প্রাচীন কাল থেকে ছেলেদের ধুতি পাঞ্জাবি এবং মেয়েদের শাড়ির ব্যবহার কিন্তু চলেই এসেছে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে। আজকে জেনে নেবো মেয়েদের শাড়ির এক অন্যতম পছন্দের শ্রেণী তাঁত সম্পর্কে। তাঁত ব্যবহার করেননি এমন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ বাংলায় হাতে গোনা, কিন্তু এই তাঁত গত পাঁচশো বছরেরও বেশি সময় ধরে বাংলায় যেভাবে লড়াই করে এসেছে তার ইতিহাস সত্যিই অবাক করার মতো।

যেমনটি প্রথমেই বললাম, তাঁতের আনুমানিক বয়স ৫০০ বছরেরও বেশি। বলা হয় মোঘল সাম্রাজ্যের সময় তাঁতের খ্যাতি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়। এসময় মসলিন তাঁত ব্যবহার করতেন অপেক্ষাকৃত ধনী বা রাজগৃহের মানুষেরা আর সুতির কাপড় ব্যবহার করতেন বাদবাকি সাধারণ মানুষ। পরবর্তীকালে যখন ভারতে ব্রিটিশ রাজত্ব শুরু হয় ঠিক তখন ইংরেজ সরকারের চক্ষুশূল হয়ে দাঁড়ায় তাঁত শিল্প। এই জমানায় ম্যানচেস্টারে তৈরি কাপড় ভারতীয় বাজারে ভরিয়ে দিতে চেষ্টা করে ব্রিটিশ সরকার, সাথে সাথে তাঁত এবং তাঁত শিল্পে বাধা নিষেধ লাগু করা হয়। কিন্তু এই কঠিন সময়ের মধ্যেও হার মানেনি তাঁত, অনেক চড়াই উৎরাই দেখলেও নিজেকে ঠিক টিকিয়ে রেখেছে বাংলার এই ঐতিহ্যশালী শিল্প। বাংলা ভাগের সময় আদি ঢাকার বহু মানুষ এপার বাংলায় চলে আসেন, বলা হয় আদি বসাক সম্প্রদায়ের তাঁতিরাই সবচেয়ে পুরোনো তাঁত শিল্পী। প্রথমে তারা সিন্ধু অববাহিকা থেকে পশ্চিমবঙ্গে এসে তাঁতের কাজ শুরু করেন। কিন্তু সেখানকার আবহাওয়া শাড়ি তৈরির জন্য অনুকূল নয় দেখার পর তারা নতুন জায়গার সন্ধান করতে শুরু করেন, এবং শেষে বহু জায়গায় ঘুরে, পর্যবেক্ষণ করে তাদের ঠাঁয় হয় বাংলাদেশের রাজশাহীতে। সেখানেও কয়েকদিন বসবাস করার পর পরিস্থিতি অনেকাংশে অসুবিধায় ফেলে দেয় তাদের, এরপর তাদের ইতিহাস থেকে জানা যায় যে তারা দুটি দলে বিভক্ত হয়ে অর্ধেক চলে আসেন কিশোরগঞ্জে, এবং আরেকটি দল চলে যায় ঢাকায়। এরপর নিজস্ব বিবাদের জেরে বসাকরা চৌহাট্টা ও ধামরাইয়াতে বসবাস করতে শুরু করেন পাকাপাকি ভাবে।


তাঁত তৈরি হয় সুতি থেকে। উৎপাদিত সুতো প্রথমে রাসায়নিক ভাবে ধোয়া হয়, তারপর সেগুলি শোকানো হয় রোদে, তারপর সেই সুতো সাদা করা হয় আবারও রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় করা, এবার সেগুলিকে আবার শুকিয়ে রঙিন ফুটন্ত জলে ডুবিয়ে দেওয়া হয়। এর পরেই সুতোয় ভাতের মাড় দেওয়া হয় এবং সেগুলিকে বাঁশের মধ্যে আরও শক্ত এবং সূক্ষ্ম করার জন্যে বেঁধে রাখা হয়। তাঁত যন্ত্রে সুতো টানাটানি ভাবে আটকে রাখা হয়। বাঁ দিক ডানদিকে আড়াআড়ি সুতোকে টানা এবং ওপর নিচে থাকা সুতোকে পোড়েন বলা হয়। তাঁত যন্ত্রে যে হাতল ঝোলানো থাকে তাকে মাকু বলা হয়। এছাড়াও তাঁত যন্ত্রের আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রধান অঙ্গগুলির নাম - দক্তি, শানা এবং নরাজ। তাঁতের শাড়ির আঁচলে বা গোটা গায়ে সাধারণত নকশা দ্বারা চিহ্নিত করা হয়, এই নকশাগুলি তাঁত শিল্পীরাই আঁকেন। একটি তাঁতের শাড়ি বয়ন সম্পূর্ন হতে গড়ে দশ থেকে বারো ঘন্টা পর্যন্ত সময় লাগে। কিন্তু শাড়ির কাজ যদি শক্ত বা জটিল হয়, সেই কাজ শেষ হতে কখনও কখনও পাঁচ বা ছ'দিন সময় লাগতে পারে।


তাঁতের কাপড় যে অঞ্চলে বোনা হয় বা কাপড়ে চিত্রিত নকশার ওপর ভিত্তি করে সেই কাপড়ের শ্রেণি বিভাগ করা যেতে পারে। পশ্চিমবঙ্গের যে সমস্ত অঞ্চলে এই মুহূর্তে তাঁতের কাপড় সবচেয়ে বেশি উৎপাদন হয় সেগুলি যথাক্রমে নদীয়ার ফুলিয়া ও শান্তিপুর, হুগলির ধনেখালি, আতপুর, বেগমপুর, এবং বর্ধমানের কালনা। টাঙ্গাইল থেকে যারা দেশ ভাগের আগে এপার বাংলায় চলে এসেছিলেন তাদের একটা বড় ভাগ ফুলিয়াতে থাকতে শুরু করেছিলেন, বর্তমানে ফুলিয়া এবং শান্তিপুর এলাকার মানুষ একত্রিত হয়ে যে ধরনের শাড়ি তৈরি করেন তাকে ফুলিয়া টাঙ্গাইল বলা হয়। এখানকার শিল্পীরা তথাকথিত ভাবে সবচেয়ে সুন্দর, মসৃণ এবং রঙিন শাড়ি তৈরি করে থাকে, এবং এর জনপ্রিয়তাও বিপুল। ধনিয়াখালী থেকে যে তাঁতের কাপড় উৎপন্ন হয় সেগুলিও ভীষণ ভালো মানের। সাধারণত কম নকশা এবং ছাপার কাজ করাই এর পরিচয় বহন করে। এছাড়া হুগলির বেগমপুর এর শাড়ি তুলনামূলক ভাবে হালকা ওজনের হওয়ার জন্য বিখ্যাত এবং আতপুরের নামডাক ছড়িয়ে পড়ার কারণ ছিল এখনকার নিত্যদিনের পরার কাপড় ও ধুতির জন্য। আমরা বাংলায় আটপৌরে শব্দটা ব্যবহার করি পুরোনো দিনের কাপড় পরার ধরনের ভিত্তিতে, এই শব্দটি আতপুর থেকেই এসেছে। আবার বর্ধমানের কালনা অঞ্চলে টাঙ্গাইল তাঁত বোনা হয়।

সময়ের সাথে তাঁত যন্ত্র ব্যবহার ক্রমশ কমে এসেছে, তাঁতের সাথে সাথে বাজারে অন্য বহু কাপড়ের ধরন উপলব্ধ হওয়ায় মানুষের কাছে এখন সুযোগ আর বিকল্প অনেক বেশি। দেশের স্বাধীনতার পূর্বে ব্রিটিশ সরকার বাৎসরিক দেড় লক্ষ পাউন্ডের পণ্য প্রতিবছর রপ্তানি করলেও একটা সময় তার তাঁত শিল্প বন্ধ করে নিজেদের তৈরি পোশাক বাজারে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু স্বদেশী আন্দোলনের দরুন তাঁত বেঁচে গেলেও স্বাধীনতা পরবর্তী যুগে এই শিল্পের বিশেষ কোনও খেয়াল রাখা হয়নি, গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। ফলে ক্রমশ তাঁত শিল্পের অবনতি নেমে এসেছে ধনেখালি, শান্তিপুর জুড়ে। কিন্তু তাঁতিরা তাদের পৈতৃক জীবিকা ছেড়ে দিতে নারাজ, এই জীবিকা তাদের বংশগৌরব। সরকারি পক্ষ থেকে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল পরবর্তী কালে। তারওপর ভিত্তি করেই এই শিল্পের ভবিষ্যত নির্ভর করে।

তথ্যসুত্র ও ছবিঃ গুগল ও https://www.facebook.com/soumisfashionhub
ভিডিওঃ সঞ্জয় কুমার দত্ত


COMMENTS

নাম

অজানা তথ্য,5,আন্তর্জাতিক,6,ছোটগল্প,2,ডিয়ার বেঙ্গল,23,বিনোদন,19,ব্লগSHOT,24,ভাগ্যলিপি,1,ভারতকথা,3,ভ্রমন কাহিনী,6,লাইফস্টাইল,16,সাম্প্রতিক,100,স্বাস্থ্য কথা,13,হ্যাংলা পেটুক,6,
ltr
item
Bong24.in: বাংলার ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্পের ইতিবৃত্ত - বিলুপ্তির পথে বাংলার তাঁত শিল্প ! - BONG 24
বাংলার ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্পের ইতিবৃত্ত - বিলুপ্তির পথে বাংলার তাঁত শিল্প ! - BONG 24
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEheyfIydsCHlLYmi4yncauc3VB0PjgCbP2uT1hHv3Ez_Ihq5rK30PXZoZyV6Reo0q4P842-oX27ebiPbF6fKmZX_ZKVCpbW2mB8VWPqg92qhtiVqr_tLvox5WBZ4aqCeykiu1PVG89XL9gB9mS9l0IALpTbzJ-I798VSFhwmaPq5wOwO31PqwAhkQ/s16000/TANT.jpg
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEheyfIydsCHlLYmi4yncauc3VB0PjgCbP2uT1hHv3Ez_Ihq5rK30PXZoZyV6Reo0q4P842-oX27ebiPbF6fKmZX_ZKVCpbW2mB8VWPqg92qhtiVqr_tLvox5WBZ4aqCeykiu1PVG89XL9gB9mS9l0IALpTbzJ-I798VSFhwmaPq5wOwO31PqwAhkQ/s72-c/TANT.jpg
Bong24.in
https://www.bong24.in/2022/08/Bengal-handloom-history.html
https://www.bong24.in/
https://www.bong24.in/
https://www.bong24.in/2022/08/Bengal-handloom-history.html
true
3543138551337409656
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts VIEW ALL Readmore Reply Cancel reply Delete By Home PAGES POSTS View All RECOMMENDED FOR YOU LABEL ARCHIVE SEARCH ALL POSTS Not found any post match with your request Back Home Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share to a social network STEP 2: Click the link on your social network Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy Table of Content